প্রতিবন্ধী কত প্রকার: শ্রেণিবিভাগ, বৈশিষ্ট্য এবং সমাজে অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব
আধুনিক সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এক সময় তাদের সমাজের বোঝা হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন তাদেরকে সম্মানের সাথে সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আধুনিক সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এক সময় তাদের সমাজের বোঝা হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন তাদেরকে সম্মানের সাথে সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। কিন্তু অনেকেই এখনো জানেন না প্রতিবন্ধী কত প্রকার এবং প্রত্যেক প্রকারের বৈশিষ্ট্য কীভাবে আলাদা। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো প্রতিবন্ধীদের ধরণ, সমাজে তাদের ভূমিকা এবং তাদের জন্য কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কে?
সংজ্ঞা ও সাধারণ ধারণা
প্রতিবন্ধী বলতে এমন একজন মানুষকে বোঝায় যার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা, শারীরিক গতিশীলতা বা মানসিক স্বাভাবিকতায় দীর্ঘমেয়াদী কোনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা তাকে দৈনন্দিন কাজকর্ম, শিক্ষা বা সামাজিক যোগাযোগে বাধাগ্রস্ত করে।
আইনি দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশ সরকার 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩'-এ প্রতিবন্ধী শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সেই ব্যক্তি যার শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত বা ইন্দ্রিয়জনিত ব্যাধি রয়েছে এবং তা দীর্ঘমেয়াদে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে।
প্রতিবন্ধী কত প্রকার?
শ্রেণিবিভাগ
প্রশ্নটি অনেকের মনে আসে—প্রতিবন্ধী কত প্রকার? মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমতে প্রতিবন্ধীদের প্রধানত ৫টি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়।
১. শারীরিক প্রতিবন্ধী
শারীরিক প্রতিবন্ধীরা এমন ব্যক্তি যারা শরীরের কোনো অঙ্গ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আংশিক বা পূর্ণ ব্যবহার করতে অক্ষম। যেমন: পা অচল, হাত অচল, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ইত্যাদি।
২. শ্রবণ প্রতিবন্ধী
এই শ্রেণির মানুষরা একেবারে শুনতে পান না বা অনেক কম শোনেন। অনেক সময় জন্ম থেকেই এমন হয় আবার দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার কারণেও হতে পারে।
৩. দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী
দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা এই শ্রেণিতে পড়েন। এর মধ্যে অন্ধ, ঝাপসা দৃষ্টি বা চোখের অন্যান্য জটিলতা অন্তর্ভুক্ত।
৪. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী
এরা মানসিকভাবে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হন। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা সাধারণত জন্ম থেকেই থাকে এবং তা আজীবন প্রভাব বিস্তার করে।
৫. মানসিক প্রতিবন্ধী বা আচরণগত প্রতিবন্ধী
এই ধরণের প্রতিবন্ধীরা সাধারণত মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন। যেমন: অবসাদ, সিজোফ্রেনিয়া, অটিজম, এবং অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজে অবদান
প্রতিভার বিকাশ
প্রতিবন্ধী মানেই অযোগ্য নয়। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি লেখালেখি, চিত্রকলা, সংগীত, খেলাধুলা এমনকি প্রযুক্তিতে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিলে তারা সমাজের জন্য মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে পারেন।
কর্মসংস্থান
বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা নির্ধারণ করছে। তারা প্রশাসনিক কাজ, আইটি, কাস্টমার সার্ভিস, বা ক্রাফটস তৈরির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাচ্ছেন। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন—"প্রতিবন্ধী ভাতা", "বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচি"—এই উন্নয়নকে উৎসাহ দিচ্ছে।
প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুবিধা
শিক্ষা
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা পাঠক্রম, সহকারী শিক্ষক এবং বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন সাধারণ স্কুলেও তাদের জন্য সাপোর্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
চিকিৎসা ও থেরাপি
সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও কাউন্সেলিং-এর মতো সেবা চালু করা হয়েছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এইসব সেবা বিনামূল্যে বা কম খরচে দিয়ে থাকে।
ভাতা ও সহায়তা
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মাসিক ভাতা, রেশন কার্ড, এবং পুনর্বাসনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও অনেক এনজিও কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
আজও অনেক মানুষ প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করে। অনেকেই তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে বা করুণা করে দেখে। এই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, গণমাধ্যমে ইতিবাচক উপস্থাপন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহনশীলতা শেখানো অত্যন্ত জরুরি।
অবকাঠামো সমস্যা
বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি ভবনে প্রতিবন্ধীদের চলাফেরার উপযোগী অবকাঠামো নেই। হুইলচেয়ার র্যাম্প, বিশেষ টয়লেট, এলিভেটর—এসব সুবিধা সবখানে নিশ্চিত করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্যতা
প্রযুক্তি এখন সবার অধিকার, কিন্তু প্রতিবন্ধীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। ব্রেইল কীবোর্ড, স্পিচ রিডার, মোবাইল অ্যাপ—এসব প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে হবে।
উপসংহার
প্রতিবন্ধীতা কোনো বাধা নয়, বরং একেকজন মানুষকে ভিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়। আমাদের সমাজে নানা ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন এবং প্রতিটি শ্রেণির চাহিদা ও সহায়তা ভিন্ন। তাই এই প্রশ্নের গুরুত্ব অনেক—প্রতিবন্ধী কত প্রকার। এ প্রশ্নের উত্তর জানা মানে শুধু শ্রেণিবিন্যাস জানা নয়, বরং সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধ বেড়ে যাওয়া। প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার—সব পক্ষকেই একসাথে কাজ করতে হবে। কারণ, সব মানুষই সম্মানের যোগ্য এবং সবাইকেই এগিয়ে চলার সুযোগ দিতে হবে।